March 29, 2024, 10:47 am
ব্রেকিং :

একটেমরা ইনজেকশান: টসিলিজুমাব গোত্রের এই ঔষধটি যে কারণে হন্যে হয়ে খুঁজছেন করোনা রোগীদের স্বজনেরা

এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা। ঢাকার বাসিন্দা সৌরভ সাহার বাবা করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসারা তার শরীরে একটি ঔষধ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। সেই ঔষধের নাম একটেমরা। টসিলিজুমাব গোত্রের একটি ইনজেকশন হচ্ছে এই ‘একটেমরা’।

টানা তিনদিন এই ইনজেকশন জোগাড়ের জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরেন মি. সাহা।

শেষ পর্যন্ত এই ঔষধের আমদানিকারক এবং পরিবেশক রেডিয়েন্ট থেকে এটি ক্রয় করতে সক্ষম হন তিনি।

“এই ঔষধের জন্য সেখানে দীর্ঘ লাইন। বহু মানুষ অপেক্ষা করছিল এটি কেনার জন্য। কিন্তু তাদের ঔষধ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। বিদেশ থেকে আসতে সময় লাগছিল,” বলছিলেন মি. সাহা।

এই ঔষধ তার বাবার শরীরে প্রয়োগের পর শরীর কিছুটা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল। ফলে চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্বিতীয় ডোজের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজের ঔষধ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি সৌরভ সাহার পক্ষে।

ইতোমধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তার মৃত্যু হয় তার বাবার।

মি. সাহা বলেন, “ডাক্তাররা বলেছিলেন, যদি দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যেতো তাহলে হয়তো ওনার সম্ভাবনা থাকতো। কিন্তু সময়মতো সেটা তো আর সংগ্রহ করতে পারিনি।”

এই ঔষধের এতো চাহিদা কেন?

টসিলিজুমাব ঔষধটি মূলত আর্থ্রাইটিস বা বাত রোগের ঔষধ।

কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, টসিলিজুমাব ঔষধটি কোভিড-১৯ আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের অনেকের ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর, এপ্রিল মাসের শুরু থেকে ঔষধটির প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে।

এই ঔষধের উৎপাদক সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত রোশ কোম্পানি। বাংলাদেশে এই ঔষধ আমদানি করে রেডিয়েন্ট বিজনেস কনসোর্টিয়াম।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে প্রতি তিন থেকে চারদিন পরপর সুইজারল্যান্ড থেকে এই ঔষধ আসে।

প্রতিবার ২০০-২৫০ ভায়েল ঔষধ আসে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তিনগুণ চাহিদা তৈরি হয়েছে বলে চিকিৎসক এবং হাসপাতাল সূত্রগুলো বলছে।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড-১৯ নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের কনসালট্যান্ট সাজ্জাদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার পরে অনেকের ফুসফুসের ভেতরে একটা বড় ধরণের ঝড় তৈরি হয়। সেটা ঠেকানোর জন্য এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।

“যাদের ফুসফুস ৬০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। এটা একটা সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট (সহায়ক চিকিৎসা)। এটা দিলেই যে ভালো হয়ে যাবে তা নয়,” বলেন ডা. সাজ্জাদ হোসেন।

“আমাদের এখানে এবারে করোনাভাইরাসের যে ভ্যারাইটি হয়েছে সেখানে আক্রান্তদের মধ্যে অনেকের ফুসফুস চার থেকে পাঁচদিনে মধ্যে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, এই ঔষধের কিছু গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। তবে সেটা সবার ক্ষেত্রে নয়। এটার হার খুব কম। রোগীর অবস্থা পর্যালোচনা করে এই ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।

রোশ বাংলাদেশের তরফ থেকে বিবিসি বাংলাকে জানানো হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্বজুড়ে টসিলিজুমাব ঔষধটির চাহিদা বেড়েছে।

রোশ বাংলাদেশ জানিয়েছে, একটেমরা ঔষধটি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রথম ব্যবহার করা হয় চীনে ২০২০ সালের মার্চ মাসে। এরপর আরো কিছু দেশ একই রকম পদ্ধতি অনুসরণ করে।

রোশ বাংলাদেশ বলছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে একদিকে এই ঔষধের চাহিদা তৈরি হয়েছে অন্যদিকে উৎপাদন সীমাবদ্ধতার কারণে সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে।

কারণ বায়োটেক ঔষধের উৎপাদন, বিতরণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। সেজন্য এই ঔষধের সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানায় রোশ বাংলাদেশ।

তারপরেও এই সংকটের সময় ঔষধটির সর্বোচ্চ সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানায় রোশ বাংলাদেশ।

কালোবাজারের বিপদ

সৌরভ সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা বাবার জন্য একটেমরা ঔষধটি নির্ধারিত বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ৬০০ গ্রামের একটি ভায়েল ক্রয় করেছিলেন ৬৫,০০০ টাকায়।

কিন্তু এরপর তার বাবার জন্য দ্বিতীয় ভায়েল প্রয়োজন হলে নির্ধারিত বিক্রয়কেন্দ্রে সে ঔষধ আর পাওয়া যায়নি। এজন্য তিনি বিভিন্ন মানুষকে অনুরোধ করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ফেসবুকে একটি গ্রুপে এই ঔষধ বিক্রির খবর জানতে পারেন। কোন উপায় না পেয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করেন সৌরভ সাহা।

ফেসবুকভিত্তিক সে বিক্রেতারা জানান, ভারত থেকে তারা এই ঔষধ নিয়ে আসেন।

“যেখানে আমি আগে ৬০০ গ্রাম কিনেছি ৬৫,০০০ টাকায় কিন্তু তারা আমার কাছে ৪০০ গ্রামের দাম চেয়েছিল দেড় লাখ টাকা,” বলেন সৌরভ সাহা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ.ব.ম. ফারুক বলেন, হাসপাতাল কিংবা অনুমোদিত বিক্রয় কেন্দ্র থেকে এই ঔষধ না কিনলে যথেষ্ট বিপদ হতে পারে।

কারণ বায়োটেক প্রযুক্তির ঔষধ হবার কারণে ‘একটেমরা’ ঔষধ সংরক্ষণ করতে হয় দুই থেকে আট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়।

এই তাপমাত্রা বজায় না থাকলে ঔষধটি কার্যকরী হবে না বলে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ফারুক।

“তাপমাত্রা একটু এদিক-সেদিক সেদিক হলে ঔষধটি কার্যকরী হবে না। উল্টো রোগীর জন্য বিপদ হতে পারে। তখন হয়তো চিকিৎসকরা ভাবতে পারেন, এতো ভালো একটা ঔষধ দেবার পরেও কাজ হলো না কেন,” বলেন অধ্যাপক ফারুক।

সূত্র: বিবিসি



ফেসবুক পেইজ