April 18, 2024, 9:38 am

ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ

বর্তমানে বিশ্বে আলোচিত নাম করোনা ভাইরাস চীনের পর হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, ফান্স, কানাডা,নেদারল্যান্ড, ব্রাজিল, ইরান, ভারত, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে। অথচ আমরা কি জানি একটি দেশ রয়েছে যে দেশে আক্রান্ত রয়েছে ঠিক তবে একজন মানুষও এই রোগে মারা যায়নি।

আমরা মনে ওই দেশের অভিজ্ঞতা কে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ সহ ইউরোপ দেশ গুলো। সেই ভাগ্যবান দেশটির নাম ভিয়েতনাম।

০৪ এপ্রিল পর্যন্ত এই রোগে মারা যায়নি এ দেশে কেউ । তাদের আক্রান্তের সংখ্য মাত্র ২৭০ জন তার মধ্যে ২২০ সুস্থ হয়ে গেছে।
জানা যায়, প্রায় ১০ কোটি মানুষের দেশ ভিয়েতনাম এই লেখা তৈরির সময় সর্বশেষ ছয় দিনে দেশটিতে কেউ সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

চীনের সঙ্গে রয়েছে ভিয়েতনামের প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের সীমান্ত পথ। ভিয়েতনাম থেকে চীনে হাজার হাজার মানুষের আসা-যাওয়া। তার পরও করোনা ভাইরাস কিছুই করতে পারেনি এ দেশ কে।

কীভাবে ভাইরাস মোকাবিলায় ভিয়েতনাম অবিশ্বাস্য সফলতা দেখিয়েছে সেটা সমগ্র বিশ্বের কাছেই এখন এক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠছে। কারও মৃত্যু না হলেও ভিয়েতনামে এ পর্যন্ত করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ নাগরিকের।

দেশটির কোয়ারেন্টিনে আছেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ। এসবই শুরু সেই জানুয়ারি থেকে। ওই মাসেই দেশটিতে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে। ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য খাত এখনো সরকারি প্রয়াস নির্ভর এবং মোটেই উন্নত দেশগুলোর মতো নয়।

প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য সেখানে চিকিৎসকের সংখ্যা ৮। ৪৭টি কেন্দ্রীয় এবং প্রায় এক হাজার ছোট স্থানীয় পর্যায়ের হাসপাতাল রয়েছে সেখানে। আছে বেসরকারি হাসপাতালও। তবে স্বাস্থ্য খাতের শক্তি ও দক্ষতার চেয়ে করোনা মোকাবিলায় ভিয়েতনামের সফলতা মূলত রাজনৈতিক দূরদর্শিতায়।

রোগ ধরা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি দেশটির নেতৃত্ব। তার আগেই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সতর্কতায় কাজে নেমে পড়েছিল তারা।

গত ফেব্রুয়ারী মাসে সে দেশের সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয় হয়ে যায়। শুরুতে যারাই সংক্রমিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের

চলাফেরা-মেলামেশার ইতিহাস সংগ্রহ করা হতো। সংক্রমিত ব্যক্তিদের কাছে আসা মানুষদেরও পরীক্ষার আওতায় আনা হয় ব্যাপক হারে। কমিউনিটি জুড়ে শুরু হয় প্রচার ও সচেতনতার কাজ।

গত ১৭ মার্চ থেকে দেশটিতে জনসমাগম স্থলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। মাস্কের দাম বাড়ানোকে বড় আকারে শাস্তি আওতায় আনা হয়। ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য লুকানোকেও শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় ‘মাস্কের ফ্রি এটিএম বুথ খোলা হয়।মার্চ থেকেই ভিয়েতনামে আসা সব নাগরিককে বাধ্যতামূলক আইসোলেশনে নেওয়া হয়।

বিদেশিদের আসায় সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। হোটেল ও সামরিক ছাউনিগুলোর অনেকটিকে অস্থায়ী হাসপাতাল ও আশ্রয় কেন্দ্র বানিয়ে ফেলা হয়। বিমান বন্দরগুলে তে আসার খবর আগেই ঘোষণা করা হতো এবং সব যাত্রীকে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক করা হয়। বিমানবন্দরেও বিনা খরচে ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়।

যে এলাকায় সংক্রমণের খবর আসতো সেখানে পুরো এলাকা কে কোয়ারেন্টিন করে টেস্ট শুরু হতো। কোয়ারেন্টিন করা জায়গার আশপাশেই খোলা হতো অস্থায়ী আশ্রয় ও চিকিৎসা কেন্দ্র। ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেই দেশের হ্যানয় থেকে ২৫ মাইল দূরে সন-লই নামের একটা গ্রামে যখন কয়েক জনের দেহে করোনা পজিটিভ’ শনাক্ত হয়, তখন প্রায় ১০ হাজার মানুষের পুরো এলাকা ২০ দিনের জন্য লকডাউন করে টেস্ট শুরু হয়।

ফার্মাসিগুলো থেকেও তথ্য নেওয়া শুরু হয়, কে কী ওষুধ কিনেছে। সেই ইতিহাস ধরেও দেশটিতে টেস্ট করা হয় অনেক। কাজগুলো কঠিন ছিল না। কেবল প্রশাসনকে বহুমুখীকরণ করা হয়েছিল। এভাবে ভিয়েতনামের প্রশাসন হাঁটছিল ভাইরাসটির আগে আগে। অন্য দেশগুলো এক মাস পর দেখা গেল ছুটছে সংক্রমণের পিছু পিছু।

মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ রোগী থাকার পরও এপ্রিলে এসে দেশটি করোনা সংকটকে ‘জাতীয় মহামারি তুল্য সমস্যা ঘোষণা করে। এতে পুরোনো প্রশাসনিক উদ্যোগ গুলোই আরও জোরালো করা হয়। ফলে দেশটির অর্থনীতি গত কয়েক মাসে তেমন হোঁচট খায়নি।

ভিয়েতনাম প্রমাণ করেছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব মানসম্মত না হয়েও করোনা মোকাবিলায় সফল হওয়া যায় যদি সবার সহযোগীতা ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা থাকে।

ভিয়েতনামে করোনা কারও প্রাণ নিতে পারেনি। শুরু থেকেই সামাজিক দূরত্বকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে ভিয়েতনামের মানুষ সূত্র রয়টার্স। ভিয়েতনামে করোনা কারও প্রাণ নিতে পারেনি। শুরু থেকেই সামাজিক দূরত্বকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে ভিয়েতনামের মানুষ।

। ইরান, ফিনল্যান্ড, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশে যাচ্ছে এখন ভিয়েতনামের কিট। আমেরিকা বলছে, তারাও এটা নিতে ইচ্ছুক। ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ কম রাখতে ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য প্রশাসন হাসপাতালের রুমগুলো পরিষ্কার করাসহ অনেক কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।

এ ছাড়া চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সবার খাবার দাবার প্রস্তত রাখার জন্য বড় সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। দীর্ঘ সময়ে কাজের উপযোগী পোশাক সরবরাহ করা হয় চিকিৎসকদের।
প্রতি দফায় ডিউটির জন্য এক সেট পোশাক দেওয়া হতো। টয়লেটে যাওয়া কমাতে এই চিকিৎসাকর্মীদের বিশেষ ধরনের ডায়াপারও দেওয়া হয়।

খাদ্য দ্রব্য সরবরাহ সচল রাখতে মাস্কের এটিএম বুথের মতোই চালেরও বুথ খোলা হয় ভিয়েতনামে। ভিয়েতনামের এই ‘চাল-বুথ’ করোনাকালে বিশ্বের বড় খবর ছিল। এসব কাজে খরচ সামাল দিতে দেশটির সরকার একটা তহবিল গঠনের ডাক দিলে তাতে সরকারি-বেসরকারি তরফ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার জমা পড়ে।

এই তহবিল গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয়ভাবে করোনা মোকাবিলার কাজে সবার অংশ গ্রহণের বোধ তৈরি করা হয়।

সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা এখনো ৩০০ নিচে হলেও ভিয়েতনাম ১০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা করার মতো ওষুধ ও মালামাল মজুত রাখার ঘোষণা দিয়েছে কিছুদিন আগেই, যা দেশটির নাগরিকদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ বাড়িয়েছে।

ভিয়েতনামের নীতিনির্ধারকেরা কেবল ভাইরাসকে থামিয়েই নিজেরা থামেননি দেশটিতে সংক্রমণ কম থাকা সত্ত্বেও ভাইরাস যুদ্ধে সেখানকার সরকারের আরেকটি বড় উদ্যোগ ছিল ‘টেস্ট কিট’ নিয়ে গবেষণা এবং এটা তৈরিতে নামা।
এ ক্ষেত্রে তারা এখন বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত। জানুয়ারিতেও তারা কোরিয়া থেকে কিট আমদানি করেছিল। এপ্রিলে এসে দেখা যাচ্ছে, কিটের গবেষণা ও উৎপাদন শেষে তারা সেটা প্রায় ২০টি দেশে রপ্তানি শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতি মধ্যে ‘মেড ইন ভিয়েতনাম’ কিটের স্বীকৃতি দিয়েছে

কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফল হিসেবে ভিয়েতনাম যে এশিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় পছন্দস্থল হয়ে উঠতে চলেছে, সেটাই ছিল ওই সব সংবাদ মাধ্যমের অনুমান।

বাংলাদেশ অনেক সময়ই বিভিন্ন রপ্তানি দ্রব্যে ভিয়েতনামকে প্রতিদ্বন্দী ভাবে। কিন্তু ভিয়েতনামের রাজনৈতিক প্রশাসন থেকেও হয়তো অনেক কিছু শেখার ছিল আমাদের।

মো: রবিউল ইসলাম খান
গণমাধ্যম কর্মী, লক্ষ্মীপুর
ইমেল:robiul.journalist@gmail.com



ফেসবুক পেইজ